ইসলামী বছরের বারোটি মাসের মধ্যে ১২ই রবিউল আউয়াল শরীফের দিবসটি প্রকৃত একজন মুসলমানের নিকট ঈমানী মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক চেতনাসহ স্মরণীয় দিন। প্রকৃত পক্ষে ১২ই রবিউল আউয়াল প্রত্যেক মুসলমানের জন্য এমন পবিত্রতম দিন, যেদিনের উছিলায় ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, শবে বরাত, শবে কদর তথা ইসলামী প্রত্যেকটি আনন্দ উৎসবের উপলক্ষ লাভে জগতবাসী ধন্য হয়েছেন। এ পবিত্রতম দিনটি হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (দ:) এ আগমনের খুশীলয়ে যদি পার্থিব জগতে সমাগত না হতো, তবে পবিত্র কাবা ঈমানের কিবলা হতো না। দ্বীন হিসাবে ধর্ম মনোনীত হতোনা। কোন মুসলমানের অস্তিত্ব থাকতো না। হাদিসে কুদসীতে বলা হয়েছে- হে নবী (দ:), আপনি যদি না হতেন নিশ্চয়ই আমি আসমান জমিন সৃষ্টি করতামনা, আর আমার রাবুবিয়্যতের ও ওয়াহদানিয়তের প্রকাশ ঘটাতাম না।
তাওহীদের এ ব্যাপক বিস্তৃতি, মানব জাতির এ অস্তিত্ব কল্পনা করা যেতো না। আসমান ও জমিনের অস্তিত্ব দুনিয়ার সবকিছু আপন গতিতে চলছে শুধু সেই পবিত্র নামের জোরে, উছিলায় আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন কতগুলো বিশেষ দিনকে মর্যাদার সাথে স্মরণ করতে এবং সসম্মানে উদযাপন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে- তোমরা তাদেরকে আল্লাহর বিশেষ দিন সমূহ স্মরণ করিয়ে দাও।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কতগুলো দিন তার দিকে সম্পর্কিত করে এ গুলোতে এক বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। অহির ফরমান অনুসারে আল্লাহর বিশেষ দিনগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম যে দিনটি সেই ১২ই রবিউল আউয়ালকেই বিশেষ মর্যাদা সহকারে অধিক যত্নবান হওয়া উচিত। ১২ই রবিউল আওয়াল এমন এক বরকতময় দিন যার শুভ মুহূর্তে সর্বপ্রথম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (দ:) এ ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছেন। এ দিনটির তাৎপর্য ব্যাখ্যায় নবী করিম (দ:)-এর সৃষ্টি শুভ জন্ম এবং নবুয়তের দায়িত্ব সম্পর্কিত বিষয়াদি আলোচনায় আসতে পারে, কারণ এ দিনটি সব রহস্যের শুভ সূচনা করেছে।
পার্থিব জগতে মানবীয় কায়া নিয়ে আগমন করার আগে আম্বিয়ায়ে কিরামগণ যে রূহানী জগতে বিরাজমান ছিলেন, তা কুরআনে পাকের আয়াতের মাধ্যমে সাব্যস্ত। এ থেকে নিঃসন্দেহে দাবী করা যায় যে, নবীদের অস্তিত্ব আলমে আরওয়াহ বা রূহের জগতে মওজুদ ছিল। শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (দ:)-এর রূহানী জগতে উপস্থিত আল কোরআনের অকাট্য প্রমাণে স্বীকৃত। কোরআনে পাকে উল্লেখ রয়েছে : স্মরণ করুন সেই সময়ের কথা যখন আল্লাহ তায়ালা রূহানী জগতে নবীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এই মর্মে যে, আমি তোমাদের কিতাব দিয়েছি, দিয়েছি হিকমাত। আর তোমাদের কাছে এমন এক সম্মানিত রাসুলের আগমন ঘটবে, যিনি তোমাদের নবুওয়াত সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সত্যায়িত করবেন, তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। আল্লাহ পাক বলেন তোমরাকি স্বীকার করেছো? এবং এ শর্তের উপর আমার ওয়াদা গ্রহণ করে নিয়েছো তো? সবাই সমন্বয়ে বলে উঠলো, আমরা সবকিছু স্বীকার করে নিলাম। আল্লাহ বললেন, তবে তোমরা সবাই সাক্ষী থেকো এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী হয়ে রইলাম।
এ আয়াতের আলোকে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, নবী করিম (দ:) আলমে আরওয়াতে শুধু উপস্থিত ছিলেন তাই নয়, বরং সে রূহানী সমাবেশের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। কেননা দুনিয়ায় শেষ নবী (দ:)-এর শুভাগমন, তাঁর কালেমার চিরন্তনী প্রতিষ্ঠা, তাঁর আবির্ভাবের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার অঙ্গীকার গ্রহণ ইত্যাদি ছিল সে মহান শপথ অধিবেশনের একমাত্র বিষয়বস্তু। আমির খসরু (র.) বলেন- সেই রূহানী অনুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র নবীকুল শিরোমণি হুজুর পাক (দ:) ছিলেন সে মহান পুত:পবিত্র আত্মা যিনি সর্বপ্রথম আল্লাহর রাবুবিয়াকের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আর তার স্বীকৃতির উপরে সমস্ত রূহানী অস্তিত্ব সমন্বয়ে একাত্মতার ঘোষণা দিয়েছিল।
তাই রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ অন্যান্য দিন থেকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ । শুধু তাই নয় অন্যান্য দিনগুলির মর্যাদা প্রাপ্তি এ দিনটির বিশেষত্বের উপর নির্ভরশীল। কেননা মহান প্রভুর যাবতীয় সৃষ্টি লীলা এ দিনটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এ প্রসঙ্গটি কুরআন ও হাদীসের আলোকে পর্যালোচনা করলে বিষয়টি আরো সহজবোধ্য হবে। পবিত্র কালামে মাজীদে ইরশাদ হচ্ছে- হে হাবীব (দ:) আমি তো আপনাকে সমগ্র আলমের জন্য ‘রাহমাত’ হিসেবেই প্রেরণ করেছি।
আলামীন হচ্ছে আলম এর বহুবচন। সমগ্র পার্থিব জগতকে একটি আলীম বলা হয়। এমনি অজানা অসংখ্য আলম যত সৃষ্টি করা হয়েছে সবগুলো সামগ্রিক ভাবে আলামীন। আল্লাহ হচ্ছেন রাব্বুল আলামীন অর্থাৎ আলম সমূহের রব বা প্রতিপালক আর রাসুলুল্লাহ (দ:) হচ্ছেন রাহমাতুল্লিল আলামীন তথা আলম সমূহের জন্য রহমত বা করুনাসিন্ধু। এ আয়াত অকাট্যভাবে এ দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করে যে, নবী পাক (দ:) সমগ্র জগতের নয় শুধু, সমগ্র সৃষ্টির জন্য প্রেরিত রহমত। ছহীহ মুসলিম শরীফের হাদীছে বলা হয়েছে নবী পাক (দ:) এরশাদ করেন- আমি সমগ্র সৃষ্টির জন্য রাসূল হয়ে এসেছি।
নবী করীম (দ:) যখন সমগ্র সৃষ্টির জন্য রাসূল হিসেবে আগমন করেছেন তাহলে সমগ্র সৃষ্টির জন্য তাকে রহমত হিসেবে তর্কাতীত ভাবে স্বীকার করতে হবে। আলোচিত আয়াত ও হাদীসের আলোকে এ সত্য প্রমাণিত হয় যে যেমনিভাবে হুজুর কারীম (দ:) এর রিসালাত সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য ব্যাপক তেমনিভাবে তার রহমাত তথা করুনাধরণও সমগ্র সৃষ্টির জন্য ব্যাপক।
তাই তারই শুভাগমনের পবিত্র মুহূর্ত লাইলাতুল ক্বদর থেকেও উত্তম। যুগশ্রেষ্ঠ জ্ঞানতাপস ইমাম কুসতুলানী (রা:) এ বক্তব্যেও সমর্থনে তিনটি কারণ বর্ণনা করেছেন-
১. শবে কদর নবী করিম (দ:) কে উপহার দেয়া হয়েছিল বলে মহিমান্বিত। পক্ষান্তরে বেলাদতের মুহূর্তে ছরকারে দো আলম (দ:) এর সত্তাই প্রকাশ ঘটেছিল। কাজেই যার সান্নিধ্যে এসেই ক্বদরের রাত মর্যাদাপূর্ণ হয়েছে সেই জাতে পাকের প্রকাশ মুহূর্ত নিঃসন্দেহে তার চাইতে উত্তম।
২. ফিরিশতা নাযিলের ফযিলত পেয়ে শবে ক্বদর সম্মানিত আর ফিরিশতারাতো নবীজির কাছে মর্যাদার ভিখারি। সুতরাং যে মুহূর্ত স্বয়ং রাহমাতুল্লিল আলামীন এর আবির্ভাব সে মুহূর্ত শবে ক্বদরের চাইতে উত্তম।
৩. শবে ক্বদর বিশেষ রাহমাতের উপহার হয়ে এসেছে শুধুমাত্র উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য। আর সৃষ্টি জগতের সামগ্রিক রহমত হয়ে মহানবী (দ:) যে মুহূর্তে উপস্থিত হয়েছেন সে মুহূর্তের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করার উপায় আছে কি? নিশ্চয়ই নেই।
নির্ভরযোগ্য প্রমাণাদির আলোকে এ কথা প্রতীয়মান যে, রাসূলে পাক (দ:) এর আগমনের মাধ্যমেই আমরা সমস্ত নিয়ামত লাভ করেছি কাজেই তাঁর জাতে মুবারকের চাইতে উত্তম নিয়ামত জগতবাসীর কাছে আর কিছুই হতে পারেনা।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন- হে হাবীব (দ:) আপনার প্রতিপালকের নিয়ামতের চর্চা হওয়া উচিৎ। নিয়ামত লাভ করার পর সে নিয়ামাতের মহিমা প্রকাশ করা, তার উপর যথোচিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। এর প্রাপ্তির উপর ব্যাপক সন্তুষ্টির আনন্দ উচ্ছ্বাস স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যক্ত করাই হচ্ছে নিয়ামত চর্চার প্রক্রিয়া। নবীয়ে পাক যেহেতু শ্রেষ্ঠ নিয়ামত, সেহেতু তার মহাত্মেও গুণগান উত্তমরূপে প্রচার করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- হে নবী (দ:) আপনি সমুদয় সৃষ্টিকে জানিয়ে দিন আল্লাহর ফজল তথা অনুগ্রহ এবং রাহমাত যারা লাভ করে তাদের অবশ্যই উচিৎ যে, প্রাপ্তির উপর আনন্দ প্রকাশ করা এবং খুশী উদযাপন করা আর এই আনন্দ উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে তার সঞ্চিত সমস্ত নেকীর চাইতে উত্তম। প্রিয় নবী মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ ফজল ও রাহমাত। আল কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- আপনার উপর আল্লাহর সুমহান ফজিলত বা অনুগ্রহ রয়েছে।
তাছাড়া তিনিতো ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ অতএব ফজিলত ও রাহমাত হিসেবে নবী পাক (দ:)-এর প্রাপ্তির উপর আনন্দ উৎসব উদযাপনের নির্দেশ স্বয়ং রাব্বুল আলামীন দিয়েছেন। কাজেই হুজুর (দ:)-এর জাতে পাক বিকশিত হওয়ার উপরে মানুষ যেভাবেই শোকর ও আনন্দ প্রকাশ করুক না কেন সে নিয়ামতের শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্বের তুলনায় এ কৃতজ্ঞতার বহর হবে নিতান্তই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত। আমাদের জাতীয় পর্যায়ে এ উৎসব যথাসম্ভব মর্যাদা সহকারে পালন করা হয়। সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন নবী পাক (দ:) এর বেলাদতের এই শুভ দিনটি উদযাপন করে থাকে। মিলাদ মাহফিল আলোক সজ্জার ব্যবস্থা এবং পবিত্র মুহূর্তের সম্মানে জশনে জুলুছ বা শোভা যাত্রাসহ সকল আনুষ্ঠানিকতা নিঃসন্দেহে ইবাদতের মধ্যে শামিল।
তাফসীরে জালালাইন প্রণেতা আল্লামা সুয়ূতী (রা:) বলেন- হুজুর (দ:)-এর বেলাদতের শুভ মুহূর্ত শোকরিয়া প্রকাশ করা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মোস্তাহাব হবে। অতএব ১২ই রবিউল আউয়াল উদযাপনের ফজিলত বর্ণনা কওে শেষ করা যাবেনা। প্রখ্যাত ইসলামী দার্শনিক আল্লামা কাজেমী (রা:) বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাবীদ ইমাম কুস্তুলানী (রা:) এর বর্ণনা থেকে বেলাদতের দিন উদযাপন ও আনুষ্ঠানিকতার কিছু ফজিলত নিম্নে বর্ণনা করা গেল।
১. এ দিনে মিলাদেও অনুষ্ঠান করা মুসলমানের ধর্মীয় রীতি।
২. এ পবিত্র দিনে উদ্বেলিত চিত্তে আনন্দের বহি:প্রকাশের মধ্যে ইমানদারদের নিদর্শন নিহিত।
৩. এ উৎসবের পরীক্ষিত বিশেষত্ব হলো- যে বৎসর এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সে বছরের পুরোপুরি সময় উদ্যোক্তারা নিরাপত্তা ও রহমতের সাথে অতিবাহিত করবেন।
৪. ঈদে মিলাদুন্নবী (দ:) সানন্দে উদযাপন কারীরা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভের অধিকারী হন।
আল্লাহ তায়ালার অশেষ শুকরিয়া এখনো আমাদের দেশে ঈমানগার মুসলমান এ দিনটি বিশেষ মর্যাদার সাথে পালন করে থাকেন। আরও সুখের বিষয় এই যে, সরকারীভাবে আমাদের দেশে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ:) পালনের বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকে। অধিকহারে রাহমত লাভের পুণ্য আশায় যাঁরা ব্যাপকভাবে আয়োজন করে থাকেন, তাদের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্ট এবং মেহেরবানী অধিকহারে বর্তাবে এ আশা করা যায়। এ নেক কাজের বরকতে যাবতীয় রোগ, শোক, বালা মসীবত দূরীবত হবে। ব্যক্তি ও জাতির জীবনে শান্তি, কল্যাণ ফিরে আসবে। সমৃদ্ধিও পথ সুগম হবে। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে তার হাবিবের প্রতি যথাযথ ভালবাসা শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে করুণা লাভের যোগ্যতা দান করুন এবং উভয় জাহানের সাফল্য ও কামিয়াবি নসীব করুন। আমিন ছুম্মা আমীন।
লিখেছেন: মাওলানা মোতাহের উদ্দিন
উপাধ্যক্ষ, নারায়ণহাট ইসলামিয়া ফাযিল (স্নাতক) মাদ্রাসা।
ভূজপুর, ফটকছড়ি, চট্টগ্রাম।